বাস পরিবহন ব্যবস্থা কিভাবে শুরু হয়েছিল
বাস আবিষ্কারের ইতিহাস (পর্ব ১)
প্রাথমিক ধারণা ও চাকা আবিষ্কার
মানব সভ্যতার অন্যতম বড় আবিষ্কার হলো চাকা। চাকা ছাড়া আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব থাকত না। বাস আবিষ্কারের ইতিহাস বোঝার জন্য প্রথমে ফিরে যেতে হবে ৫৫০০ বছর পূর্বে, যখন চাকা প্রথম তৈরি করা হয়। মেসোপটেমিয়ায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে প্রথম চাকা ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে, প্রাচীনকালে, ঘোড়া, গাধা বা ষাঁড় দিয়ে গাড়ি টেনে নেওয়ার চল ছিল। এই ধারাবাহিকতা থেকেই পরবর্তীতে গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রথম ধারণা জন্ম নেয়।
১৭০০ শতকের হর্স-ড্রন কোচ
বাসের পূর্বসূরী হিসেবে ধরা যেতে পারে হর্স-ড্রন কোচকে, যা ১৭০০ শতকে ইউরোপে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। কোচ ছিল এক ধরনের বড় গাড়ি, যা বেশ কয়েকজন যাত্রীকে একসাথে বহন করতে সক্ষম ছিল। এটি অনেকটা আজকের বাসের মতোই কাজ করত। ঘোড়ার টানে চলা এই কোচগুলো শহর থেকে শহরে চলাচল করত এবং এটি ছিল মানুষের জন্য প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা।
১৭শ শতকে ফ্রান্সে স্ট্যানিসলাস বাউড্রয় নামের একজন ব্যবসায়ী প্রথমবারের মতো একটি নির্ধারিত রুটে ঘোড়ায় টানা কোচ চালু করেন। প্রতিটি কোচে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী বহন করা হতো এবং যাত্রা শুরুর সময় ও স্থান নির্দিষ্ট থাকত। এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো নির্ধারিত রুটে নিয়মিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে।
বাসের প্রাথমিক ধারণার বিকাশ (পর্ব ২)
স্টিম ইঞ্জিন ও মেকানিক্যাল ট্রান্সপোর্ট
১৮০০ সালের শুরুর দিকে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপে ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটে। এই সময় স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়, যা পরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ১৮২০-এর দশকে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহার করে বড় বড় যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরি করা হয়, যেগুলো অনেকটা বাসের পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচিত।
১৮৩০ সালে স্কটল্যান্ডের জর্জ স্টিফেনসন প্রথমবারের মতো স্টিম-চালিত বাস তৈরি করেন। এই বাসে প্রায় ৮-১০ জন যাত্রী পরিবহন করা যেত। এই ধরনের স্টিম বাস মূলত লন্ডনের মতো বড় শহরগুলিতে ব্যবহার করা হতো, যা মানুষকে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে দিত। তবে স্টিম বাসের একটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল—এটি খুব বেশি গতিশীল ছিল না এবং প্রচুর জ্বালানি খরচ হতো।
ইঞ্জিন চালিত বাসের আবিষ্কার
১৮৮৫ সালে কার্ল বেন্জ প্রথমবারের মতো পেট্রোল ইঞ্জিন চালিত গাড়ি তৈরি করেন। এই গাড়িই আধুনিক বাসের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এরপর ১৮৯৫ সালে জার্মানির কার্ল বেন্জ তার পেট্রোল চালিত গাড়ির ভিত্তিতে প্রথম পেট্রোল চালিত বাস তৈরি করেন। তার তৈরি বাসে মোট ৮ জন যাত্রী বহন করা যেত এবং এটি ম্যানহেইম থেকে প্যাঞ্জওয়াইলার রুটে চলাচল করত। এই প্রথমবারের মতো নির্ধারিত রুটে ইঞ্জিন চালিত বাস চালু হয়।
বৈদ্যুতিক ও ডিজেল বাসের আবির্ভাব (পর্ব ৩)
বৈদ্যুতিক বাসের ইতিহাস
পেট্রোল চালিত বাসের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক বাসের ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৮২ সালে, ইংল্যান্ডের লন্ডনে প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয়। এই বৈদ্যুতিক ট্রামের নকশার উপর ভিত্তি করে ১৮৯০-এর দশকে বৈদ্যুতিক বাস তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। ১৮৯৯ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে প্রথম বৈদ্যুতিক বাস চালু করা হয়। তবে, সে সময় ব্যাটারির ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় এবং চার্জিংয়ের সময় বেশি লাগায় বৈদ্যুতিক বাস খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি।
ডিজেল চালিত বাস
১৯২০-এর দশকে পেট্রোল বাসের জ্বালানি খরচ কমানোর জন্য ডিজেল ইঞ্জিন চালিত বাস তৈরি করা হয়। ১৯২৩ সালে জার্মানির ম্যান ব্র্যান্ড প্রথমবারের মতো ডিজেল ইঞ্জিন চালিত বাস তৈরি করে। ডিজেল বাস ছিল পেট্রোল বাসের তুলনায় বেশি কার্যকর এবং দীর্ঘ পথ চলার উপযোগী। দ্রুতই ডিজেল ইঞ্জিন চালিত বাসগুলো ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আধুনিক বাসের বিকাশ ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন (পর্ব ৪)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়কাল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বাসের নকশা এবং প্রযুক্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যুদ্ধের সময় যাতায়াতের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাসের ধারণক্ষমতা এবং স্থায়িত্বের দিকে বেশি জোর দেওয়া হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বড় আকারের এবং বেশি যাত্রী বহন করতে সক্ষম বাসগুলো চালু করা হয়। বিশেষ করে, আমেরিকা ও ইউরোপে শহরাঞ্চলে যাত্রী পরিবহনের জন্য বিশালাকার বাস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
দোতলা বাসের আবিষ্কার
দোতলা বাসের ধারণা আসে ব্রিটেনে, যেখানে ১৯৫৬ সালে প্রথম দোতলা বাস চালু করা হয়। লন্ডনের বিখ্যাত রেড ডাবল ডেকার বাস এ সময়ের বাসগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, যা আজও লন্ডনের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আধুনিক বাসের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি (পর্ব ৫)
হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক বাসের পুনরুত্থান
বৈদ্যুতিক বাসের ধারণা অনেক পুরনো হলেও আধুনিক যুগে এটির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে পরিবেশ দূষণ কমানোর লক্ষ্যে বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড বাসের ব্যবহার বেড়েছে। উন্নত ব্যাটারি প্রযুক্তি এবং কম খরচের ফলে বৈদ্যুতিক বাসগুলো শহরাঞ্চলে পুনরায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
চীনের বিখ্যাত শহর শেনজেন বর্তমানে বৈদ্যুতিক বাসের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে, যেখানে হাজারেরও বেশি বৈদ্যুতিক বাস ব্যবহার হচ্ছে।
স্বয়ংক্রিয় বাসের উদ্ভব
বর্তমানে, স্বয়ংক্রিয় বাসের ধারণা গবেষণা এবং পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। বাসকে আরও বুদ্ধিমান এবং স্বয়ংক্রিয় করার জন্য সেন্সর, ক্যামেরা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয় বাসগুলো চালকবিহীনভাবে চলাচল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উপসংহার (পর্ব ৬)
বাসের ইতিহাস বহু শতাব্দী ধরে নানা পর্যায়ে উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রাচীনকালের ঘোড়ার গাড়ি থেকে শুরু করে বর্তমানের স্বয়ংক্রিয় এবং বৈদ্যুতিক বাস পর্যন্ত এর দীর্ঘ যাত্রা প্রযুক্তি ও সমাজের পরিবর্তনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে বাস আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, এবং ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করবে।
0 Comments