আত্মঅনুসন্ধানের গল্প: নীল জানালার চিঠি
নীল জানালার চিঠি:
রুদ্র ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। গল্প-কবিতা পড়ার প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই, তবে কলেজে এসে লেখার প্রতি আসক্তি বেড়ে গেছে। বন্ধুদের ভিড়ে সে একটু নিরালায় থাকতে ভালোবাসে, আর সেই নিরালা খুঁজে পায় এই নীল জানালার ধারে। জানালার পাশে একটা টানা বেঞ্চে সে প্রায় প্রতিদিন বসে থাকে, একা।
কয়েক মাস আগে, একদিন সেখানে বসে হঠাৎ খেয়াল করল, জানালার সিলে একটা ছোট্ট কাগজ রাখা। কৌতূহলবশত খুলে দেখল সেখানে লেখা—
তুমি কি জানো, এই জানালার পাশের কৃষ্ণচূড়াটা কবে প্রথম ফুল ফুটিয়েছিল? আমি জানি। আমি সেদিন এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রুদ্র ভেবেছিল, কেউ হয়তো মজা করে লিখেছে। কিন্তু এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সে দেখতে পায় নতুন করে লেখা কিছু কাগজ রাখা থাকত সেখানে। কখনও ছোট্ট কবিতা, কখনও ভাবনাময় কিছু লাইন, কখনও ব্যক্তিগত অনুভব।
লেখাগুলো এমনভাবে লেখা, যেন কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে। রুদ্র ধীরে ধীরে বুঝে গেল, এসব লেখা আসলে তাকে উদ্দেশ্য করেই। একদিন লেখা ছিল—
তুমি জানো, দুপুরবেলা তোমার ছায়া ঠিক জানালার ওপর পড়ে। আমি তোমার ছায়ার সাথে কথা বলি, কারণ তুমি তো কথা বলো না।
এই লেখাগুলো ধীরে ধীরে রুদ্রর প্রতিদিনের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়াল। সে নিজেও একদিন সাহস করে একটি চিরকুট লিখে রাখল জানালার পাশে—
তুমি কি সত্যিই আমাকে দেখো? আমি জানি না তুমি কে, কিন্তু আমি প্রতিদিন তোমার জন্যই এখানে আসি।
সেদিন বিকেলের আকাশটা ছিল ধূসর। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল, জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ। রুদ্র জানত না, সে উত্তর পাবে কি না। কিন্তু পরদিন দুপুরেই সে দেখল
তার লেখা চিরকুটের পাশে আরেকটা কাগজ রাখা—
তুমি চিঠি লিখেছো, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম, তুমি কোনোদিনই বুঝবে না। আমি চাইনি তুমি জানো, তবুও তোমার দিকে লেখা থেমে যায়নি কখনও।
তারপর শুরু হলো এক অদ্ভুত চিঠির সম্পর্ক। মুখোমুখি দেখা হয়নি, নামও জানে না কেউ কারও, তবুও প্রতিদিন জানালার ধারে রাখা থাকত লেখা–পাঠ। কখনও নিঃশব্দ অনুভব, কখনও হাস্যরস, কখনও গভীর দুঃখের গল্প।
একদিন রুদ্র লিখল—
তুমি কি কবিতা লেখো? তোমার শব্দে একধরনের আলো থাকে। আমার ভেতরের অন্ধকারকে ছুঁয়ে যায়।
উত্তরে সে পায়— তুমি যে জানালার পাশে বসে থাকো, আমি তোমাকে প্রতিদিন দেখি। তোমার চোখের ভিতরেই তো কবিতা থাকে। আমি শুধু শব্দে গেঁথে রাখি।
রুদ্র চেষ্টা করত লেখা থেকে কোনো ইঙ্গিত খুঁজে পেতে, যেন বোঝা যায় কে সে। কোনো মেয়ের হাতের লেখা? না কি ছেলেই? কিন্তু এমনভাবে লেখা, বোঝা যায় না কিছুই।
কলেজের ফাইনাল ইয়ারে এসে ক্লাসের চাপ বেড়ে গেল। রুদ্র অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তবুও জানালার ধারে যাওয়া বাদ দেয়নি সে। এটা তার নেশা, তার প্রেরণা।
একদিন সে লেখে—
পরবর্তীবার যদি আর দেখা না হয়, তাহলে এই চিঠির রেখায় যেন তুমি থেকে যাও। আমি তোমাকে খুঁজব না, কিন্তু ভোলারও চেষ্টা করব না।
সেদিনের পর আর কোনো উত্তর এলো না।
রুদ্র প্রতিদিন গেল, প্রতিদিন খুঁজল, কিন্তু জানালার ধারে কোনো লেখা থাকত না আর। তার মন কেমন খালি খালি লাগত। এতদিনে সে বুঝে গেছে, সে এই অচেনা মানুষটিকে ভালোবেসে ফেলেছে। যদিও দেখা হয়নি, তবুও এমন গভীর একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে যা কোনো চোখ দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলো। রুদ্র শহর ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু, নতুন জীবন। তবুও পুরনো খাতার পাতা গুলো সে রেখে দিয়েছে যত্ন করে। সময় পেলেই পড়ে।
দু’বছর কেটে গেছে। একদিন কলেজে যাওয়ার সুযোগ হলো এক পুরনো শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে। দেখা শেষে হঠাৎ পা চলে গেল সেই পেছনের করিডোরে। নীল জানালাটা এখনও আছে। একই রকম। কৃষ্ণচূড়া গাছটা আরও বড় হয়ে গেছে।
সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, পুরনো দিনগুলোর কথা মনে করে। হঠাৎ চোখে পড়ল জানালার সিলে একটা কাগজ পড়ে আছে। হাত কাঁপতে কাঁপতে খুলে দেখল পরিচিত সেই হাতের লেখা—
তুমি কি এখনও জানালা ধারে দাঁড়াও? আমি এখন দূরে, খুব দূরে। তবুও মাঝে মাঝে তোমাকে ভাবি, তোমার লেখা পড়ি। এই জানালার পাশে তোমার ছায়া এখনো পড়ে। হয়তো এইটুকুই যথেষ্ট। ভালো থেকো, জানালার মানুষ।
রুদ্রর চোখে জল এসে গেল। সে বুঝে গেল, সম্পর্কের জন্য সবসময় মুখোমুখি দেখা দরকার হয় না। কিছু সম্পর্ক শব্দে গাঁথা থাকে, অনুভবে গড়া হয়। সেই জানালার মতো, যা দিনের আলো ফেলে ভেতরে, অথচ নিজে থেকে কিছু বলে না।
সেদিন জানালার পাশে বসে রুদ্র শেষবারের মতো একটা লেখা রেখে যায়—
জানালার ওপারে যে মানুষ ছিলে, তুমি কি জানো, তোমার শব্দই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে? কোনোদিন যদি আবার ফিরে আসো, এই নীল জানালাটা খোলা থাকবে। আমার হৃদয়ের মতো।
Comments
Post a Comment